বাংলাদেশের লোকসাহিত্য প্রবন্ধ রচনা | লোকসাহিত্যের সংজ্ঞা

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বিশিষ্ট অংশ লোকসাহিত্য। বৈচিত্র্যে, ব্যাপকতায় এবং জীবনের সঙ্গে একাত্মতার উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে তা সমাদৃত। সুপ্রাচীন কাল থেকে লোকসাহিত্যের বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টি লোকমুখে প্রচলিত হয়ে আসছে এবং পুরাতন সৃষ্টি হয়েও আধুনিক মানবসমাজে সমাদৃত হচ্ছে।

বাংলাদেশের লোকসাহিত্য রচনা

বাংলাদেশের লোকসাহিত্য রচনা

লোকসাহিত্যের নামকরণ ও সংজ্ঞা ঃ লোকসাহিত্যের নাম ও সংজ্ঞা সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মতানৈক্য বিদ্যমান। ইংরেজিতে Folk-lore কথাটা যে ব্যাপক অর্থে গৃহীত হয়েছে, বাংলায় তা লোকসাহিত্য বললে তাতে পূর্ণাঙ্গ ভাবের যথার্থ প্রকাশ ঘটে না। 


Folk-lore কথাটার অনুবাদ বা প্রতিশব্দ হিসেবে লোকসাহিত্য কথাটাকে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা না করে বিভিন্ন পণ্ডিত লোকবিজ্ঞান, লোকশ্রুতি, ফোকলোর ইত্যাদি বৈচিত্র্যপূর্ণ নামে চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। তবে সুনির্দিষ্ট অর্থবহ নামের ব্যাপারে গবেষকগণের মধ্যে মতানৈক্য থাকলেও সাধারণভাবে লোকসাহিত্য কথাটাই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। 


লোকসাহিত্য বলতে জনসাধারণের মুখে মুখে প্রচলিত গাঁথা কাহিনি, গান, ছড়া, প্রবাদ ইত্যাদি বুঝানো হয়। সাধারণত কোনো সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীর অলিখিত সাহিত্যই লোকসাহিত্য। অর্থাৎ, জাতীয় সংস্কৃতির যে-সকল সাহিত্য গুণসম্পন্ন সৃষ্টি প্রধানত মৌখিক ধারা অনুসরণ করে অগ্রসর হয়, তাকে লোকসাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। 


সাহিত্য সৃষ্টি করার যে প্রবণতা চিরন্তনভাবে মানবমনে বিদ্যমান থাকে, তা-ই লোকসাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। এ ধরনের সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। মানুষের মুখে মুখে এবং পরে তা মুখে মুখেই প্রচলিত থাকে। 


প্রকৃতপক্ষে, পূর্ববর্তী কালে অশিক্ষিত সমাজের লোক দ্বারা সৃষ্ট সাহিত্য লিখে রাখার কোনো সুষ্ঠু পন্থার উদ্ভাবন করা সহজ হয় নি বলে তা স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করেই প্রচারিত হয়। আর স্মৃতিনির্ভর ছিল বলেই লোকসাহিত্য কালপরম্পরায় পরিবর্তিত হয়ে যেত এবং কাল ও অঞ্চলভেদে তার রূপেরও বিভিন্নতা লক্ষ্যযোগ্য ছিল।


লোকসাহিত্যের সৃষ্টি ঃ লোকসাহিত্য সাধারণত কোনো ব্যক্তিবিশেষের একক সৃষ্টি নয়, তা সংহত সমাজের সামগ্রিক সৃষ্টি সংহত সমাজ বলতে সেই সমাজকে বুঝায়, যার অন্তর্ভুক্ত মানবগোষ্ঠী পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ভিতর দিয়ে চিরাচরিত প্রথার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে চলে। 


লোকসাহিত্যের সমাজ বিচিত্র সাংস্কৃতিক উপকরণে সমৃদ্ধ হয়ে সাহিত্য সৃষ্টির সহায়ক হয় সমষ্টির সৃষ্টি বলে লোকসাহিত্য কোনো ব্যক্তিবিশেষের নামের সঙ্গে জড়িত থাকে না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লোকের বিক্ষিপ্ত রচনা কালক্রমে একত্রিত হয়ে একটা বিশিষ্ট সাহিত্যিক রূপ পরিগ্রহ করে। 


সমাজবদ্ধ জীবনে মানুষের ব্যক্তি পরিচয় বড় হয়ে ওঠে না বলে লোকসাহিত্য রচয়িতা হিসেবে কোনো বিশেষ কবি বা গীতি রচয়িতাকে বিবেচনা না করে সমাজকেই রচয়িতা মনে করতে হয়। প্রথমত, ব্যক্তি-বিশেষের সৃষ্টি থাকলেও জনগণের মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে তা নতুন রূপ পরিগ্রহ করে এবং পরিণামে সামগ্রিক সৃষ্টি হিসেবে গৃহীত হয়ে থাকে। 


এ প্রসঙ্গে ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর 'বাংলার লোকসাহিত্য' গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “ব্যক্তিবিশেষের মনে যে ভাবটির উদয় হয়, তার প্রকাশ অপরিণত ও অপরিস্ফুট থাকবারই কথা, ইহা দশজনের হাতে পড়িয়াই প্রকৃত সাহিত্যের রূপ লাভ করিয়া থাকে। অতএব, ব্যক্তির মনে যে-সকল অপরিণত ভাবের উদয় হয়, তাহাই সমষ্টি লোকসাহিত্যের রূপে সমাজকে পরিবেশন করে।  

লোকসাহিত্যের বহিরঙ্গগত পরিচয়ের জন্য সমষ্টির দান স্বীকার করিয়া লইলেও ইহার অন্তর্নিহিত ভাবমূলে যে ব্যষ্টির প্রেরণাই কার্যকরী হইয়া থাকে, তা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। অতএব লোকসাহিত্য ব্যষ্টি ও সমষ্টির সমবেত সৃষ্টি; ব্যষ্টির মনে যে ভাবের উদয় হয়, তাহার অসম্পূর্ণ রূপায়ণকেই সমষ্টি নিজের আদর্শে সম্পূর্ণ করিয়া লয়।”


লোকসাহিত্যের বিষয়বস্তু ঃ লোকসাহিত্যের বিষয়বস্তু সমাজের পরিবেশ থেকে গৃহীত হয় । জনশ্রুতিমূলক বিষয় এর উপাদান। বহুদিন পূর্বের কোনো ঘটনা বা কাহিনি লোকপরম্পরায় কল্পনা-রূপক মিশ্রিত হয়ে লোকসাহিত্যে স্থান পায়। সাধারণত সমসাময়িক জীবন তাতে তেমন প্রতিফলিত হয় না। 


চিরন্তন বিষয়বস্তুই সাহিত্যের উপজীব্য হয় বলে লোকসাহিত্যেও এর নিদর্শন বিদ্যমান। বহুকাল পূর্বের মানুষের সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনার রসমণ্ডিত পরিচয় লোকসাহিত্যে বিধৃত। অতীতের ইতিহাস ও সমাজচিত্র এই সাহিত্যে রূপায়িত হয়ে ওঠে। 

মানবজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা কোনো কাহিনি, গান, ছড়া, প্রবাদ ইত্যাদি আশ্রয় করে মৌলিক আকৃতি ও পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে লোকসাহিত্যের অন্তর্গত হয়ে থাকে।


লোকসাহিত্যের বৈচিত্র্যতা ঃ বাংলার লোকসাহিত্যের বিকাশের পশ্চাতে দেশের বিভিন্ন উপজাতির প্রভাব লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতির আগমন ঘটার ফলে তাদের সাংস্কৃতিক উপকরণ এদেশের জলবায়ুর সঙ্গে মিশেছে এবং তা এখানকার লোকসাহিত্যের বিকাশে সহায়তা করেছে। 


দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির লোকসাহিত্যের নিদর্শনের উৎপত্তি হলেও বাংলা ভাষা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐক্যের জন্য লোকসাহিত্যেরও মূলগত সামঞ্জস্য দেখা যায়। বিভিন্ন কালে বিভিন্ন দিক থেকে আগত বিচিত্র প্রকৃতির মানুষ পল্লিগ্রামের একই প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করে যে সাহিত্যের সৃষ্টি করেছে, তাতে যথেষ্ট ঐক্য পরিলক্ষিত হয়।


উপসংহার ঃ 

বাংলার লোকসাহিত্যে বাঙালি জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে। বর্তমান নাগরিক জীবন থেকে বহুদূরে সেই অতীতকালের সমাজের চিন্তাভাবনা লোকসাহিত্যে স্থান পেয়ে বিচিত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক যুগে এসে উপনীত হয়েছে। এ সঙ্গে অতীত জীবনের রূপটিও বহন করে নিয়ে এসেছে। 


যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে লোকসাহিত্যের পরিবর্তন ঘটলেও অতীতের চিত্র তা থেকে লুপ্ত হয়ে যায় নি। বাঙালির মনের বিচিত্র পরিচয় তার লোকসাহিত্যে লক্ষণীয়। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, ধ্যানধারণা নিয়েই এ সাহিত্য রচিত হয়ে থাকে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url